'এই বাড়িটা ভালো না ভাবী। আপনি পোয়াতি মানুষ। আপনার জামাই বিমানবাহিনীতে চাকরি করে,দুই দিন পর পর মিশনে যায়। এই অবস্থায় আপনার একা বাড়িতে থাকা ঠিক হবে না।'
প্রতিবেশীর কথায় সেদিন একটু অবাক হয়েছিলাম।মহিলাটি দেখতে সুন্দর হলেও তার জিহ্বা কদাকার কালো। আমার শয়নকক্ষের বাতায়ন খুলে তাকালেই মহিলাটির বেলকনি দেখতে পাওয়া যায়। অথচ আসার পর থেকেই দেখছি তার বাড়ির প্রতিটি দরজা জানালা বন্ধ। জানালায় আবার পর্দাও টাঙানো। ঘরের মধ্যে মানুষ আছে কিন্তু তা বাহিরে থেকে আন্দাজ করা মুশকিল। এই তো মাত্র দুই সপ্তাহ হলো গাজীপুরে শিফট হয়েছি, আমি আর আমার হাসবেন্ড। ছোট থেকে আমার বেড়ে ওঠা ঢাকাতেই। তাই গাজীপুরের এমন গাছপালা আচ্ছাদিত পরিবেশ আমার জন্য একেবারে নতুন। আমাদের বাড়িটি খুব বেশি বড়ও না আবার একেবারে ছোটও না। বাড়িটি কাঠের তৈরি দোতলা বিশিষ্ট। খুব কম মূল্যেই বাড়িটি বন্ধক নিয়েছে আমার স্বামী তুষার। আশে পাশে অন্য বাড়ি বলতে আমার প্রতিবেশী নিপা ভাবীদের বাড়ি ছাড়া আর কোন বাড়ি নেই। বাড়ির চারিদিক শালবনে ঘেরা। রাত হলেই অদ্ভুত সব নিশাচর পাখির ডাক ভেসে আসে।
আমার দিন কেটে যায় ঘরের মধ্যে সময় কাটিয়েই। এটা ওটা করতে করতে কখন যে দিন পেরিয়ে যায়! একা হাতে কাজ করতে করতে দুপুর হয়ে যায়। দুপুরে তুষার আসে। লাঞ্চ করে আবার কাজে চলে যায়। কাজ থেকে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা গড়ায়। এতটুকু সময় আমি নিজের সঙ্গে কাটিয়েই পার করে দেই।বোরিং লাগে না। আমার বাড়ির সামনে একটা কদম গাছ আছে। গাছের নিচে আছে একটা দোলনা। মাঝে মধ্যেই বিকেল হলে আমি দোলনায় গিয়ে বসি। মৃদু বাতাসে কখনো বা দোলনায় বসে গুনগুন করতে করতে বই পড়ি। ভালোই লাগে। নিপা ভাবী মাঝে মধ্যেই তখন আমার কাছে আসেন। এই বাড়ি এই জায়গা নিয়ে নানা অপ্রকৃতস্থ গল্প বলেন। ভূতের গল্প আমার বেশ লাগে। তবে আমি ভূতে বিশ্বাসী নই। কিন্তু জিন যে আছে সেটা আমি মানি,বিশ্বাস করি।
—--
আজ বিকেলেও আমি দোলানায় এসে বসি। গোসল করে মাত্রই চুল শুকানোর জন্য বাহিরে এসে বসেছি। সঙ্গে নিয়ে এসেছি হুমায়ুন আহমেদের দেবী বইটি। কতবার পড়েছি এই বই। তাও একটুও অভক্তি জাগে না।
'ভাবী আপনার কয় মাস চলে?'
হঠাৎ অপ্রস্তুত কন্ঠস্বরে আমি ভরকে উঠি। পেছনে ফিরতেই দেখি নিপা ভাবী।
'আরে আপনি? আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আর আপনি আমাকে নাম ধরেই চাইলে ডাকতে পারেন। জুলফা আমার নাম।’
নিপা ভাবী কদম গাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে বলল,
'আপাতত ভাবী বলেই না হয় ডাকি? আচ্ছা উত্তর দিলেন না যে? কয় মাস চলে আপনার?'
আমি বইয়ের পাতায় চোখ বুলিয়ে জবাব দিলাম,
'তিন মাস। তিন মাস চলে আমার। ভাবী আপনার বাড়িতে কে কে আছে? মানে অনেকদিন তো হলো এখনে এসেছি। আপনাকে ছাড়া আর কাউকেই দেখলাম না।আপনার বাচ্চারা কোথায়?’
‘আমার কোন বাচ্চা নেই।তবে একটা বাচ্চার অনেক শখ।আপনার বাচ্চ…..
আর কিছু বলার আগেই তুষারের গলা কর্নকুহরে এসে ঠেকল। বইয়ের পাতা থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকাতেই দেখতে পেলাম তুষার দাঁড়িয়ে । কদম গাছের দিকে তাকাতেই দেখি নিপা ভাবী কোথাও নেই। ওমা মহিলাটি গেল কোথায়? একটু আগেই তো এখানে ছিল।
'এমন দুপুর বেলা তুমি এখানে কি করছো? জানো না এমন সময় অনেক কিছু বেছে চলতে হয়। চলো ঘরে চলো।’
আমি প্রত্যুত্তর না দিয়ে তুষারের সঙ্গে ঘরে চলে আসি। তবে মনের মধ্যে একটাই প্রশ্ন বার বার স্লোগান তুলছে, নিপা ভাবী কোথায় গেল?
–
ঘটনার সূত্রপাত সেদিন থেকেই। মাঝ রাতে হঠাৎ পেটে প্রচন্দ ব্যাথা অনুভব হতেই ঘুমটা ভেঙে যায় আমার। ভেবেছিলাম তুষারকে জাগিয়ে তুলবো। কিন্তু এই সামান্য কারণের জন্য তাকে জাগিয়ে তোলার ইচ্ছে হলো না। সারাদিন কত খাটুনি করে লোকটা। ঘড়ির কাঁটায় তখন বোধহয় ২:৩৫। আমি বিছানা ছেড়ে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসি।রান্নাঘরে যাই। ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি বের করে পান করি। হঠাৎ মনে হলো ড্রয়িং রুমে কেউ একজন বসে আছে। একনাগাড়ে কিছু একটা বিরবির করছে। বিষ্ময়ে আমার ভ্রু কুঁচকে এলো। মাত্রই তো ড্রয়িং রুমের সামনে দিয়ে এলাম। তখন তো কাউকে দেখলাম না?
সাহস করে ড্রয়িং রুমের দিকে এগুতে লাগলাম। যত এগুচ্ছি ততই শব্দটা বেড়েই যাচ্ছে সঙ্গে সোফায় বসে থাকা ব্যাক্তির ছায়াটাও ড্রিম লাইটের আলোয় বড় হচ্ছে। কাছে যেতেই দেখি একটা কালো কুচকুচে বিড়াল। আমার দিকেই অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে ম্যাঁও ম্যাঁও করছে। বিরবির শব্দটা এখন আর নেই। বোধহয় মনের ভ্রম ছিল।
‘এ দেখি একটা বিড়াল! কিন্তু এটা ঘরে কি করে ডুকলো?’
হঠাৎ চোখ যায় জানালার দিকে। দেখতে পাই জানালা খোলা। তার মানে জানালাটা আজকে আর লাগানো হয় নি। কিন্তু স্পষ্ট মনে আছে বিকেলেই আমি রোজকার মত সব জানালা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। বিড়ালটিকে তাড়াতে হয় না। সে নিজেই জানালা দিয়ে বেড়িয়ে যায়। হঠাৎ আমার চোখ যায় জানালার বহির্ভূত দৃশ্যের দিকে। কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। অথচ কি দেখা যাচ্ছে তা আমি ঠিক করে আন্দাজ করতে পারছি না। অকস্মাৎ আমার পেছন থেকে একটা অদ্ভুত ভারী গলা ভেসে আসে,
‘ তোর বাচ্চাটা আমায় দিবি?’
আমার মাথাটা হঠাৎ ব্যাথায় ছটফট করে উঠে। পেছন ফিরে তাকানোর আগেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। পরে কি হয়েছিল মনে নেই। সকালে যখন ঘুম ভাঙে তখন দেখি তুষার আমার পাশেই বসে আছে। স্বামীকে রাতের কথা জিজ্ঞেস করতেই সে বলল,
‘আমি তো ওয়াশরুমের জন্য উঠেছিলাম। হঠাৎ দেখলাম তুমি পাশে নেই। তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে যখন নিচে নেমে আসি তখন দেখতে পাই তুমি ড্রয়িং রুমের মেঝেতে পড়ে আছো। তারপর আর কি?তোমাকে কোলে তুলে রুমে এনে শোয়ালাম। কি হয়েছিল বলো তো?’
কিছুই মনে পড়ছিল না। তাই উত্তর দিতে চেয়েও তুষারকে কিছু বলতে পারলাম না। তবে কানে এখনো একটা কথাই বাজছে,
‘তোর বাচ্চাটা আমায় দিবি?’
—---
আজ এই বাড়িতে আমার একমাস পূর্ণ হলো।এই এক মাসে আমার সঙ্গে তেমন কিছুই ঘটে নি। সব স্বাভাবিক ছিল। কাল সকালে তুষার খাগড়াছড়ি যাবে। তিন দিনের একটা মিশনে। এ ক'দিন সে অনেক জায়গায় একটা মেয়ে মানুষ খুঁজেছে ২৪ ঘন্টা আমার তদারকি করার জন্য। আমার সঙ্গে থাকার জন্য। কিন্তু এটা তো আর ঢাকা শহর না যে মানুষ চাইলাম আর মেয়ে পেয়ে গেলাম। তুষার আমাকে একা রেখে কিছুতেই যেতে চাইছিল না। কিন্তু কি আর করার? সরকারি চাকরি বলে কথা!
বিকেলে বাহিরে থেকে কাপড় আনতে গিয়ে দেখি কোথা থেকে যেন নিপা ভাবী ব্যাগ-পত্তর নিয়ে বাড়ি ডুকছে। সঙ্গে ছোট একটা মেয়ে,একজন পুরুষ আর দু'জন বৃদ্ধা-বৃদ্ধও ছিল। আমি ভাবী বলে হাঁক ছাড়তেই সে আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো।
‘ভাবী কোথা থেকে আসছেন?এত সব নিয়ে কোথায় গিয়েছিলেন?যাক এক মাস পর আপনার পরিবারের সদস্যদের দেখা মিলল।বাচ্চা গুলো তো বিকেলে বাহিরেও আসে না।’
নিপা ভাবীর কপালে ভাঁজ পড়লো এবার। সে আমার বাড়ির দিকে একবার তাকালো তারপর বলল,
‘আপনি আমাকে কি করে চিনেন?আমার নাম কি করে জানলেন?আর আপনাকে তো আমি ঠিক চিনতে পারলাম না?কে আপনি?’
নিপা ভাবীর কথায় আমি পুরোই কিংকর্তব্যবিমুঢ়। এসব কি বলছে উনি?এখানে আসার পর থেকেই উনার সাথে আমার কত ভাব। আর আজকে বলছে আমাকে নাকি সে চিনে না। আমি কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবো তার আগেই ভাবীর সঙ্গে থাকা পুরুষটি তাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল,
‘আতিয়া জলদি বাড়ির চাবিটা দাও। একমাসে না জানি ঘরের কি হাল হয়েছে। এই মণি তোর মায়ের থেকে চাবিটা নিয়ে আয় তো।’
ছোট্ট মেয়েটা দৌড়ে নিপা ভাবীর কাছে এলো চাবি নেওয়ার জন্য। নিপা ভাবী মেয়েটিকে বলল,
‘যাও আব্বুর কাছে। আম্মু আসছি।’
তারপর আমার দিকে একবার তাকিয়ে বলল,
‘পরে কথা হবে।’
ভাবী আমার জবাবের জন্য অপেক্ষা না করেই চলে গেল। সে চলে যেতেই লোকটি মৃদু কন্ঠে তাকে জিজ্ঞেস করল,কে ওই মহিলা?এই বাড়িতে উঠছে বুঝি?
সবাই আমার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকালো। আমার বেশ অস্তিত্ব লাগছিল। তাই এক মুহুর্ত দেরি না করে আমি কাপড় নিয়ে বাড়ির ভেতর চলে এলাম। তুষার বাড়িতেই ছিল। তাকে আমি সব খুলে বললাম। তার নিজের মাথাও কাজ করছে না। সে আর আমাকে কি বুঝাবে? এবার মাথায় আমার আরেকটা প্রশ্ন ভোঁ ভোঁ করছে, নিপা ভাবী আমাকে চিনতে পারলো না কেন?নাকি ইচ্ছে করেই কোন কারন বসত না চেনার ভান করেছে সে? আর ভাবীর তো কোন বাচ্চা নেই । তবে ভাবীর কথার ধরন শুনে কেন মনে হচ্ছিলো ছোট্ট মেয়েটি তার নিজেরই। আর ওই লোকটি তাকে আতিয়া বলেই বা কেন ডাকল?তার নাম তো নিপা।
—
সন্ধ্যায় হাসের মাংস আর চালের রুটি করেছি। শীতকালীন সময়ে এটা তুষারের পছন্দের খাবার। স্বামীটা আমার কাল চলে যাবে। না জানি এই তিনদিন কি না কি খায়। তাই যতটুকু পেরেছি,ততটুকুই করেছি। কাজ শেষে যখন এক বাটি মাংস আর রুটি নিয়ে চলে যাওয়ার জন্য রান্না ঘরের লাইটটা বন্ধ করে বেরিয়ে আসলাম তখনি নাকে একটা পঁচা দুর্গন্ধ এসে ধাক্কা খেল। বমি চলে আসার উপক্রম। হঠাৎ রান্নাঘর থেকে শব্দ এলো,মনে হলো কেউ পাতিলের ঢাকনা সরিয়েছে। আরেকটু খেয়াল করতেই এবার আরো অদ্ভুত এক শব্দ কানে বাজলো,মনে হলো কে যেন খপখপ করে সব ছিড়েখুঁড়ে খাচ্ছে। আমি দ্রুত টেবিলে মাংসের বাটিটা রেখে রান্না ঘরে ডুকলাম। লাইট অন করতেই দেখি সেখানে কিছুই নেই। সব স্বাভাবিক।নেই কোনো শব্দ, সেই কোলাহল। ধ্যাত আজ-কাল হরর মুভি একটু বেশিই দেখা হচ্ছে। তারই ইফেক্ট এসব।
সেদিন রাতে আমি সবচেয়ে বেশি অবাক হই। যখন রাতে খাবারের সময় রান্নাঘরে গিয়ে দেখি মাংসের পাতিলে এক টুকরো মাংসও নেই। পাতিলের তলায় শুধুমাত্র পড়ে আছে ঝোল। পর পর কেমন যেন সব অদ্ভুত ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। এখন নিজের ভেতরেও খানিকটা ভয় কাজ করা শুরু করে। সব সময় তো সবকিছু একজন মানুষের ভ্রম হওয়া সম্ভব নয়। তুষার কে বিষয়টি জানানোর পর যে বলে,
‘আজ তো রাত হয়ে গেছে। সকালে আমাকে আবার খাগড়াছড়িও যেতে হবে। তিনদিন একটু
কষ্ট করো। যদি দেখো তিনদিনে সব স্বাভাবিক আছে তাহলে তো ভালোই। তা না হলে আমি বাড়ি ফিরেই হুজুরকে এনে একটা মিলাদের ব্যবস্থা করবো।’
আমিও তাতে রাজি হলাম। তবুও তুষারের আমাকে ফেলে যেতে বেশ চিন্তা হচ্ছিলো। তাই সে আমার ছোট ননদকে কল করে দুই-একদিনের ভেতর এখানে আসতে বলে। সঙ্গে আমার শাশুড়ীও আসবে। শুনে একটু খুশী হলাম। বাড়িতে একা থাকার চেয়ে তাদের এখানে চলে আসাই ভালো। এমনিতেও বছর শেষেই আমার শশুর-শাশুরি আর ননদ-দেবরের এখানে চলে আসার কথা। কিন্তু সামনেই দেবরের এক্সাম আছে তাই সবাই ঠিক করেছে একেবারে বছরটা শেষ করেই তারা এখানে শিফট হবে।
-
পরদিন আমার দিনটা খুব একটা ভালো যায় না। তুষারের জন্য অনেক মন খারাপ হচ্ছিলো। অদ্ভুত একটা ভয়ও মনের মধ্যে বাসা বেঁধে বসে ছিলো।
সেদিন রাত দেড়টায় হঠাৎ বিকট এক শব্দে আচমকা ঘুম ভেঙে যায় আমার। রাত ভালোই হয়েছে। আমার আবার একটা বোধ অভ্যাস আছে। একবার ঘুম ভাঙলে সহজে ঘুম আসে না। তুষারটা চলে গেছে বিধায় মনটা কেমন কেমন জানি করছে। সারাটা দিনও আজকে কেমন যেন একগুয়ে কেটেছে। ফোনটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ ফেসবুকে স্ট্রোলিং করতে থাকি। হঠাৎ তুষারের কল আসে। প্রথমে একটু অবাক হই। এত রাতে কল করেছে?পরে ভাবলাম সারাদিন কাজ করে এখন হয়তো রাত জেগে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া হচ্ছে। ফোন রিসেভ করতেই তুষার একটা কথাই বলল,সব ঠিক আছে?
ব্যাস সঙ্গে সঙ্গে লাইনটা কেটে যায়। নেট সমস্যা হয়তো। আমি উঠে বারান্দায় যাই। হঠাৎ দোলনার দিকে তাকাতেই মনে হলো কে যেন দোলনায় পা ঝুলিয়ে বসে গুন গুন করছে। মেয়েলি কন্ঠস্বর। আমার শরীরটা শিউরে উঠে। আয়াতুল কুরসী পড়তে পড়তে বারান্দার দরজা বন্ধ করে রুমে চলে এলাম। তুষারকে বেশ কয়েকটি কল করি, কিন্তু ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে। খুব ভয় করছিল আমার। হঠাৎ আননোন নাম্বার থেকে একটা কল আসে,কলটা ধরতেই ওপার থেকে ভেসে আসে একটা অস্পষ্ট কন্ঠ। ভয়েজটা কেটে কেটে আসছিল। ভাবলাম হয়তো কোন সমস্যা হয়েছে দেখে তুষার অন্য কারো নাম্বার থেকে কল করেছে। নেট সমস্যার কারনে কথা অস্পষ্ট শোনাচ্ছে । একটা কল আসার পর আর কোন কল আসে নি।তাই আমিও আর এহেন বিষয়ে এত মাথা ঘামালাম না। ঘুম আসছে না।এখনো ভয় করছে। বিছানায় এসে দোয়া পড়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছি। হঠাৎ অনুভূত হলো পিঠের ওপর কেমন যেন শীতল নিঃশ্বাস পতন হচ্ছে। ধীরে ধীরে নিঃশ্বাসের শব্দ বাড়তে শুরু করে। মনে হচ্ছে এই তো ঠিক আমার পেছনেই কেও একজন শুয়ে আছে। কিন্তু সেটা তো অসম্ভব বিষয়। বাড়িতে তো এই মুহুর্তে আমি ব্যাতিত কেউ নেই?আমি আয়াতুল্লাহ কুরসী আরো দ্রুত পড়তে শুরু করলাম।যত গুলো দোয়া মাথায় আসছে অনবরত তা পাঠ করছি। কিন্তু নিঃশ্বাসের শীতল বাতাসটা তখনো আমার পিঠে লাগছে। এবার আমি দোয়া পড়তে পড়তে আস্তে আস্তে করে ঘাড় বাঁকিয়ে পেছনে ফেরার চেষ্টা করি। পেছন ফিরতেই আমার চক্ষু চড়কগাছ।মুখ থেকে অস্পষ্ট স্বরে শুধু বেরিয়ে আসে,
‘নিপা ভাবী?’........
সমাপ্ত
প্রতিবেশীর কথায় সেদিন একটু অবাক হয়েছিলাম।মহিলাটি দেখতে সুন্দর হলেও তার জিহ্বা কদাকার কালো। আমার শয়নকক্ষের বাতায়ন খুলে তাকালেই মহিলাটির বেলকনি দেখতে পাওয়া যায়। অথচ আসার পর থেকেই দেখছি তার বাড়ির প্রতিটি দরজা জানালা বন্ধ। জানালায় আবার পর্দাও টাঙানো। ঘরের মধ্যে মানুষ আছে কিন্তু তা বাহিরে থেকে আন্দাজ করা মুশকিল। এই তো মাত্র দুই সপ্তাহ হলো গাজীপুরে শিফট হয়েছি, আমি আর আমার হাসবেন্ড। ছোট থেকে আমার বেড়ে ওঠা ঢাকাতেই। তাই গাজীপুরের এমন গাছপালা আচ্ছাদিত পরিবেশ আমার জন্য একেবারে নতুন। আমাদের বাড়িটি খুব বেশি বড়ও না আবার একেবারে ছোটও না। বাড়িটি কাঠের তৈরি দোতলা বিশিষ্ট। খুব কম মূল্যেই বাড়িটি বন্ধক নিয়েছে আমার স্বামী তুষার। আশে পাশে অন্য বাড়ি বলতে আমার প্রতিবেশী নিপা ভাবীদের বাড়ি ছাড়া আর কোন বাড়ি নেই। বাড়ির চারিদিক শালবনে ঘেরা। রাত হলেই অদ্ভুত সব নিশাচর পাখির ডাক ভেসে আসে।
আমার দিন কেটে যায় ঘরের মধ্যে সময় কাটিয়েই। এটা ওটা করতে করতে কখন যে দিন পেরিয়ে যায়! একা হাতে কাজ করতে করতে দুপুর হয়ে যায়। দুপুরে তুষার আসে। লাঞ্চ করে আবার কাজে চলে যায়। কাজ থেকে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা গড়ায়। এতটুকু সময় আমি নিজের সঙ্গে কাটিয়েই পার করে দেই।বোরিং লাগে না। আমার বাড়ির সামনে একটা কদম গাছ আছে। গাছের নিচে আছে একটা দোলনা। মাঝে মধ্যেই বিকেল হলে আমি দোলনায় গিয়ে বসি। মৃদু বাতাসে কখনো বা দোলনায় বসে গুনগুন করতে করতে বই পড়ি। ভালোই লাগে। নিপা ভাবী মাঝে মধ্যেই তখন আমার কাছে আসেন। এই বাড়ি এই জায়গা নিয়ে নানা অপ্রকৃতস্থ গল্প বলেন। ভূতের গল্প আমার বেশ লাগে। তবে আমি ভূতে বিশ্বাসী নই। কিন্তু জিন যে আছে সেটা আমি মানি,বিশ্বাস করি।
—--
আজ বিকেলেও আমি দোলানায় এসে বসি। গোসল করে মাত্রই চুল শুকানোর জন্য বাহিরে এসে বসেছি। সঙ্গে নিয়ে এসেছি হুমায়ুন আহমেদের দেবী বইটি। কতবার পড়েছি এই বই। তাও একটুও অভক্তি জাগে না।
'ভাবী আপনার কয় মাস চলে?'
হঠাৎ অপ্রস্তুত কন্ঠস্বরে আমি ভরকে উঠি। পেছনে ফিরতেই দেখি নিপা ভাবী।
'আরে আপনি? আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আর আপনি আমাকে নাম ধরেই চাইলে ডাকতে পারেন। জুলফা আমার নাম।’
নিপা ভাবী কদম গাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে বলল,
'আপাতত ভাবী বলেই না হয় ডাকি? আচ্ছা উত্তর দিলেন না যে? কয় মাস চলে আপনার?'
আমি বইয়ের পাতায় চোখ বুলিয়ে জবাব দিলাম,
'তিন মাস। তিন মাস চলে আমার। ভাবী আপনার বাড়িতে কে কে আছে? মানে অনেকদিন তো হলো এখনে এসেছি। আপনাকে ছাড়া আর কাউকেই দেখলাম না।আপনার বাচ্চারা কোথায়?’
‘আমার কোন বাচ্চা নেই।তবে একটা বাচ্চার অনেক শখ।আপনার বাচ্চ…..
আর কিছু বলার আগেই তুষারের গলা কর্নকুহরে এসে ঠেকল। বইয়ের পাতা থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকাতেই দেখতে পেলাম তুষার দাঁড়িয়ে । কদম গাছের দিকে তাকাতেই দেখি নিপা ভাবী কোথাও নেই। ওমা মহিলাটি গেল কোথায়? একটু আগেই তো এখানে ছিল।
'এমন দুপুর বেলা তুমি এখানে কি করছো? জানো না এমন সময় অনেক কিছু বেছে চলতে হয়। চলো ঘরে চলো।’
আমি প্রত্যুত্তর না দিয়ে তুষারের সঙ্গে ঘরে চলে আসি। তবে মনের মধ্যে একটাই প্রশ্ন বার বার স্লোগান তুলছে, নিপা ভাবী কোথায় গেল?
–
ঘটনার সূত্রপাত সেদিন থেকেই। মাঝ রাতে হঠাৎ পেটে প্রচন্দ ব্যাথা অনুভব হতেই ঘুমটা ভেঙে যায় আমার। ভেবেছিলাম তুষারকে জাগিয়ে তুলবো। কিন্তু এই সামান্য কারণের জন্য তাকে জাগিয়ে তোলার ইচ্ছে হলো না। সারাদিন কত খাটুনি করে লোকটা। ঘড়ির কাঁটায় তখন বোধহয় ২:৩৫। আমি বিছানা ছেড়ে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসি।রান্নাঘরে যাই। ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি বের করে পান করি। হঠাৎ মনে হলো ড্রয়িং রুমে কেউ একজন বসে আছে। একনাগাড়ে কিছু একটা বিরবির করছে। বিষ্ময়ে আমার ভ্রু কুঁচকে এলো। মাত্রই তো ড্রয়িং রুমের সামনে দিয়ে এলাম। তখন তো কাউকে দেখলাম না?
সাহস করে ড্রয়িং রুমের দিকে এগুতে লাগলাম। যত এগুচ্ছি ততই শব্দটা বেড়েই যাচ্ছে সঙ্গে সোফায় বসে থাকা ব্যাক্তির ছায়াটাও ড্রিম লাইটের আলোয় বড় হচ্ছে। কাছে যেতেই দেখি একটা কালো কুচকুচে বিড়াল। আমার দিকেই অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে ম্যাঁও ম্যাঁও করছে। বিরবির শব্দটা এখন আর নেই। বোধহয় মনের ভ্রম ছিল।
‘এ দেখি একটা বিড়াল! কিন্তু এটা ঘরে কি করে ডুকলো?’
হঠাৎ চোখ যায় জানালার দিকে। দেখতে পাই জানালা খোলা। তার মানে জানালাটা আজকে আর লাগানো হয় নি। কিন্তু স্পষ্ট মনে আছে বিকেলেই আমি রোজকার মত সব জানালা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। বিড়ালটিকে তাড়াতে হয় না। সে নিজেই জানালা দিয়ে বেড়িয়ে যায়। হঠাৎ আমার চোখ যায় জানালার বহির্ভূত দৃশ্যের দিকে। কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। অথচ কি দেখা যাচ্ছে তা আমি ঠিক করে আন্দাজ করতে পারছি না। অকস্মাৎ আমার পেছন থেকে একটা অদ্ভুত ভারী গলা ভেসে আসে,
‘ তোর বাচ্চাটা আমায় দিবি?’
আমার মাথাটা হঠাৎ ব্যাথায় ছটফট করে উঠে। পেছন ফিরে তাকানোর আগেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। পরে কি হয়েছিল মনে নেই। সকালে যখন ঘুম ভাঙে তখন দেখি তুষার আমার পাশেই বসে আছে। স্বামীকে রাতের কথা জিজ্ঞেস করতেই সে বলল,
‘আমি তো ওয়াশরুমের জন্য উঠেছিলাম। হঠাৎ দেখলাম তুমি পাশে নেই। তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে যখন নিচে নেমে আসি তখন দেখতে পাই তুমি ড্রয়িং রুমের মেঝেতে পড়ে আছো। তারপর আর কি?তোমাকে কোলে তুলে রুমে এনে শোয়ালাম। কি হয়েছিল বলো তো?’
কিছুই মনে পড়ছিল না। তাই উত্তর দিতে চেয়েও তুষারকে কিছু বলতে পারলাম না। তবে কানে এখনো একটা কথাই বাজছে,
‘তোর বাচ্চাটা আমায় দিবি?’
—---
আজ এই বাড়িতে আমার একমাস পূর্ণ হলো।এই এক মাসে আমার সঙ্গে তেমন কিছুই ঘটে নি। সব স্বাভাবিক ছিল। কাল সকালে তুষার খাগড়াছড়ি যাবে। তিন দিনের একটা মিশনে। এ ক'দিন সে অনেক জায়গায় একটা মেয়ে মানুষ খুঁজেছে ২৪ ঘন্টা আমার তদারকি করার জন্য। আমার সঙ্গে থাকার জন্য। কিন্তু এটা তো আর ঢাকা শহর না যে মানুষ চাইলাম আর মেয়ে পেয়ে গেলাম। তুষার আমাকে একা রেখে কিছুতেই যেতে চাইছিল না। কিন্তু কি আর করার? সরকারি চাকরি বলে কথা!
বিকেলে বাহিরে থেকে কাপড় আনতে গিয়ে দেখি কোথা থেকে যেন নিপা ভাবী ব্যাগ-পত্তর নিয়ে বাড়ি ডুকছে। সঙ্গে ছোট একটা মেয়ে,একজন পুরুষ আর দু'জন বৃদ্ধা-বৃদ্ধও ছিল। আমি ভাবী বলে হাঁক ছাড়তেই সে আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো।
‘ভাবী কোথা থেকে আসছেন?এত সব নিয়ে কোথায় গিয়েছিলেন?যাক এক মাস পর আপনার পরিবারের সদস্যদের দেখা মিলল।বাচ্চা গুলো তো বিকেলে বাহিরেও আসে না।’
নিপা ভাবীর কপালে ভাঁজ পড়লো এবার। সে আমার বাড়ির দিকে একবার তাকালো তারপর বলল,
‘আপনি আমাকে কি করে চিনেন?আমার নাম কি করে জানলেন?আর আপনাকে তো আমি ঠিক চিনতে পারলাম না?কে আপনি?’
নিপা ভাবীর কথায় আমি পুরোই কিংকর্তব্যবিমুঢ়। এসব কি বলছে উনি?এখানে আসার পর থেকেই উনার সাথে আমার কত ভাব। আর আজকে বলছে আমাকে নাকি সে চিনে না। আমি কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবো তার আগেই ভাবীর সঙ্গে থাকা পুরুষটি তাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল,
‘আতিয়া জলদি বাড়ির চাবিটা দাও। একমাসে না জানি ঘরের কি হাল হয়েছে। এই মণি তোর মায়ের থেকে চাবিটা নিয়ে আয় তো।’
ছোট্ট মেয়েটা দৌড়ে নিপা ভাবীর কাছে এলো চাবি নেওয়ার জন্য। নিপা ভাবী মেয়েটিকে বলল,
‘যাও আব্বুর কাছে। আম্মু আসছি।’
তারপর আমার দিকে একবার তাকিয়ে বলল,
‘পরে কথা হবে।’
ভাবী আমার জবাবের জন্য অপেক্ষা না করেই চলে গেল। সে চলে যেতেই লোকটি মৃদু কন্ঠে তাকে জিজ্ঞেস করল,কে ওই মহিলা?এই বাড়িতে উঠছে বুঝি?
সবাই আমার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকালো। আমার বেশ অস্তিত্ব লাগছিল। তাই এক মুহুর্ত দেরি না করে আমি কাপড় নিয়ে বাড়ির ভেতর চলে এলাম। তুষার বাড়িতেই ছিল। তাকে আমি সব খুলে বললাম। তার নিজের মাথাও কাজ করছে না। সে আর আমাকে কি বুঝাবে? এবার মাথায় আমার আরেকটা প্রশ্ন ভোঁ ভোঁ করছে, নিপা ভাবী আমাকে চিনতে পারলো না কেন?নাকি ইচ্ছে করেই কোন কারন বসত না চেনার ভান করেছে সে? আর ভাবীর তো কোন বাচ্চা নেই । তবে ভাবীর কথার ধরন শুনে কেন মনে হচ্ছিলো ছোট্ট মেয়েটি তার নিজেরই। আর ওই লোকটি তাকে আতিয়া বলেই বা কেন ডাকল?তার নাম তো নিপা।
—
সন্ধ্যায় হাসের মাংস আর চালের রুটি করেছি। শীতকালীন সময়ে এটা তুষারের পছন্দের খাবার। স্বামীটা আমার কাল চলে যাবে। না জানি এই তিনদিন কি না কি খায়। তাই যতটুকু পেরেছি,ততটুকুই করেছি। কাজ শেষে যখন এক বাটি মাংস আর রুটি নিয়ে চলে যাওয়ার জন্য রান্না ঘরের লাইটটা বন্ধ করে বেরিয়ে আসলাম তখনি নাকে একটা পঁচা দুর্গন্ধ এসে ধাক্কা খেল। বমি চলে আসার উপক্রম। হঠাৎ রান্নাঘর থেকে শব্দ এলো,মনে হলো কেউ পাতিলের ঢাকনা সরিয়েছে। আরেকটু খেয়াল করতেই এবার আরো অদ্ভুত এক শব্দ কানে বাজলো,মনে হলো কে যেন খপখপ করে সব ছিড়েখুঁড়ে খাচ্ছে। আমি দ্রুত টেবিলে মাংসের বাটিটা রেখে রান্না ঘরে ডুকলাম। লাইট অন করতেই দেখি সেখানে কিছুই নেই। সব স্বাভাবিক।নেই কোনো শব্দ, সেই কোলাহল। ধ্যাত আজ-কাল হরর মুভি একটু বেশিই দেখা হচ্ছে। তারই ইফেক্ট এসব।
সেদিন রাতে আমি সবচেয়ে বেশি অবাক হই। যখন রাতে খাবারের সময় রান্নাঘরে গিয়ে দেখি মাংসের পাতিলে এক টুকরো মাংসও নেই। পাতিলের তলায় শুধুমাত্র পড়ে আছে ঝোল। পর পর কেমন যেন সব অদ্ভুত ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। এখন নিজের ভেতরেও খানিকটা ভয় কাজ করা শুরু করে। সব সময় তো সবকিছু একজন মানুষের ভ্রম হওয়া সম্ভব নয়। তুষার কে বিষয়টি জানানোর পর যে বলে,
‘আজ তো রাত হয়ে গেছে। সকালে আমাকে আবার খাগড়াছড়িও যেতে হবে। তিনদিন একটু
কষ্ট করো। যদি দেখো তিনদিনে সব স্বাভাবিক আছে তাহলে তো ভালোই। তা না হলে আমি বাড়ি ফিরেই হুজুরকে এনে একটা মিলাদের ব্যবস্থা করবো।’
আমিও তাতে রাজি হলাম। তবুও তুষারের আমাকে ফেলে যেতে বেশ চিন্তা হচ্ছিলো। তাই সে আমার ছোট ননদকে কল করে দুই-একদিনের ভেতর এখানে আসতে বলে। সঙ্গে আমার শাশুড়ীও আসবে। শুনে একটু খুশী হলাম। বাড়িতে একা থাকার চেয়ে তাদের এখানে চলে আসাই ভালো। এমনিতেও বছর শেষেই আমার শশুর-শাশুরি আর ননদ-দেবরের এখানে চলে আসার কথা। কিন্তু সামনেই দেবরের এক্সাম আছে তাই সবাই ঠিক করেছে একেবারে বছরটা শেষ করেই তারা এখানে শিফট হবে।
-
পরদিন আমার দিনটা খুব একটা ভালো যায় না। তুষারের জন্য অনেক মন খারাপ হচ্ছিলো। অদ্ভুত একটা ভয়ও মনের মধ্যে বাসা বেঁধে বসে ছিলো।
সেদিন রাত দেড়টায় হঠাৎ বিকট এক শব্দে আচমকা ঘুম ভেঙে যায় আমার। রাত ভালোই হয়েছে। আমার আবার একটা বোধ অভ্যাস আছে। একবার ঘুম ভাঙলে সহজে ঘুম আসে না। তুষারটা চলে গেছে বিধায় মনটা কেমন কেমন জানি করছে। সারাটা দিনও আজকে কেমন যেন একগুয়ে কেটেছে। ফোনটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ ফেসবুকে স্ট্রোলিং করতে থাকি। হঠাৎ তুষারের কল আসে। প্রথমে একটু অবাক হই। এত রাতে কল করেছে?পরে ভাবলাম সারাদিন কাজ করে এখন হয়তো রাত জেগে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া হচ্ছে। ফোন রিসেভ করতেই তুষার একটা কথাই বলল,সব ঠিক আছে?
ব্যাস সঙ্গে সঙ্গে লাইনটা কেটে যায়। নেট সমস্যা হয়তো। আমি উঠে বারান্দায় যাই। হঠাৎ দোলনার দিকে তাকাতেই মনে হলো কে যেন দোলনায় পা ঝুলিয়ে বসে গুন গুন করছে। মেয়েলি কন্ঠস্বর। আমার শরীরটা শিউরে উঠে। আয়াতুল কুরসী পড়তে পড়তে বারান্দার দরজা বন্ধ করে রুমে চলে এলাম। তুষারকে বেশ কয়েকটি কল করি, কিন্তু ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে। খুব ভয় করছিল আমার। হঠাৎ আননোন নাম্বার থেকে একটা কল আসে,কলটা ধরতেই ওপার থেকে ভেসে আসে একটা অস্পষ্ট কন্ঠ। ভয়েজটা কেটে কেটে আসছিল। ভাবলাম হয়তো কোন সমস্যা হয়েছে দেখে তুষার অন্য কারো নাম্বার থেকে কল করেছে। নেট সমস্যার কারনে কথা অস্পষ্ট শোনাচ্ছে । একটা কল আসার পর আর কোন কল আসে নি।তাই আমিও আর এহেন বিষয়ে এত মাথা ঘামালাম না। ঘুম আসছে না।এখনো ভয় করছে। বিছানায় এসে দোয়া পড়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছি। হঠাৎ অনুভূত হলো পিঠের ওপর কেমন যেন শীতল নিঃশ্বাস পতন হচ্ছে। ধীরে ধীরে নিঃশ্বাসের শব্দ বাড়তে শুরু করে। মনে হচ্ছে এই তো ঠিক আমার পেছনেই কেও একজন শুয়ে আছে। কিন্তু সেটা তো অসম্ভব বিষয়। বাড়িতে তো এই মুহুর্তে আমি ব্যাতিত কেউ নেই?আমি আয়াতুল্লাহ কুরসী আরো দ্রুত পড়তে শুরু করলাম।যত গুলো দোয়া মাথায় আসছে অনবরত তা পাঠ করছি। কিন্তু নিঃশ্বাসের শীতল বাতাসটা তখনো আমার পিঠে লাগছে। এবার আমি দোয়া পড়তে পড়তে আস্তে আস্তে করে ঘাড় বাঁকিয়ে পেছনে ফেরার চেষ্টা করি। পেছন ফিরতেই আমার চক্ষু চড়কগাছ।মুখ থেকে অস্পষ্ট স্বরে শুধু বেরিয়ে আসে,
‘নিপা ভাবী?’........
সমাপ্ত
'এই বাড়িটা ভালো না ভাবী। আপনি পোয়াতি মানুষ। আপনার জামাই বিমানবাহিনীতে চাকরি করে,দুই দিন পর পর মিশনে যায়। এই অবস্থায় আপনার একা বাড়িতে থাকা ঠিক হবে না।'
প্রতিবেশীর কথায় সেদিন একটু অবাক হয়েছিলাম।মহিলাটি দেখতে সুন্দর হলেও তার জিহ্বা কদাকার কালো। আমার শয়নকক্ষের বাতায়ন খুলে তাকালেই মহিলাটির বেলকনি দেখতে পাওয়া যায়। অথচ আসার পর থেকেই দেখছি তার বাড়ির প্রতিটি দরজা জানালা বন্ধ। জানালায় আবার পর্দাও টাঙানো। ঘরের মধ্যে মানুষ আছে কিন্তু তা বাহিরে থেকে আন্দাজ করা মুশকিল। এই তো মাত্র দুই সপ্তাহ হলো গাজীপুরে শিফট হয়েছি, আমি আর আমার হাসবেন্ড। ছোট থেকে আমার বেড়ে ওঠা ঢাকাতেই। তাই গাজীপুরের এমন গাছপালা আচ্ছাদিত পরিবেশ আমার জন্য একেবারে নতুন। আমাদের বাড়িটি খুব বেশি বড়ও না আবার একেবারে ছোটও না। বাড়িটি কাঠের তৈরি দোতলা বিশিষ্ট। খুব কম মূল্যেই বাড়িটি বন্ধক নিয়েছে আমার স্বামী তুষার। আশে পাশে অন্য বাড়ি বলতে আমার প্রতিবেশী নিপা ভাবীদের বাড়ি ছাড়া আর কোন বাড়ি নেই। বাড়ির চারিদিক শালবনে ঘেরা। রাত হলেই অদ্ভুত সব নিশাচর পাখির ডাক ভেসে আসে।
আমার দিন কেটে যায় ঘরের মধ্যে সময় কাটিয়েই। এটা ওটা করতে করতে কখন যে দিন পেরিয়ে যায়! একা হাতে কাজ করতে করতে দুপুর হয়ে যায়। দুপুরে তুষার আসে। লাঞ্চ করে আবার কাজে চলে যায়। কাজ থেকে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা গড়ায়। এতটুকু সময় আমি নিজের সঙ্গে কাটিয়েই পার করে দেই।বোরিং লাগে না। আমার বাড়ির সামনে একটা কদম গাছ আছে। গাছের নিচে আছে একটা দোলনা। মাঝে মধ্যেই বিকেল হলে আমি দোলনায় গিয়ে বসি। মৃদু বাতাসে কখনো বা দোলনায় বসে গুনগুন করতে করতে বই পড়ি। ভালোই লাগে। নিপা ভাবী মাঝে মধ্যেই তখন আমার কাছে আসেন। এই বাড়ি এই জায়গা নিয়ে নানা অপ্রকৃতস্থ গল্প বলেন। ভূতের গল্প আমার বেশ লাগে। তবে আমি ভূতে বিশ্বাসী নই। কিন্তু জিন যে আছে সেটা আমি মানি,বিশ্বাস করি।
—--
আজ বিকেলেও আমি দোলানায় এসে বসি। গোসল করে মাত্রই চুল শুকানোর জন্য বাহিরে এসে বসেছি। সঙ্গে নিয়ে এসেছি হুমায়ুন আহমেদের দেবী বইটি। কতবার পড়েছি এই বই। তাও একটুও অভক্তি জাগে না।
'ভাবী আপনার কয় মাস চলে?'
হঠাৎ অপ্রস্তুত কন্ঠস্বরে আমি ভরকে উঠি। পেছনে ফিরতেই দেখি নিপা ভাবী।
'আরে আপনি? আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আর আপনি আমাকে নাম ধরেই চাইলে ডাকতে পারেন। জুলফা আমার নাম।’
নিপা ভাবী কদম গাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে বলল,
'আপাতত ভাবী বলেই না হয় ডাকি? আচ্ছা উত্তর দিলেন না যে? কয় মাস চলে আপনার?'
আমি বইয়ের পাতায় চোখ বুলিয়ে জবাব দিলাম,
'তিন মাস। তিন মাস চলে আমার। ভাবী আপনার বাড়িতে কে কে আছে? মানে অনেকদিন তো হলো এখনে এসেছি। আপনাকে ছাড়া আর কাউকেই দেখলাম না।আপনার বাচ্চারা কোথায়?’
‘আমার কোন বাচ্চা নেই।তবে একটা বাচ্চার অনেক শখ।আপনার বাচ্চ…..
আর কিছু বলার আগেই তুষারের গলা কর্নকুহরে এসে ঠেকল। বইয়ের পাতা থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকাতেই দেখতে পেলাম তুষার দাঁড়িয়ে । কদম গাছের দিকে তাকাতেই দেখি নিপা ভাবী কোথাও নেই। ওমা মহিলাটি গেল কোথায়? একটু আগেই তো এখানে ছিল।
'এমন দুপুর বেলা তুমি এখানে কি করছো? জানো না এমন সময় অনেক কিছু বেছে চলতে হয়। চলো ঘরে চলো।’
আমি প্রত্যুত্তর না দিয়ে তুষারের সঙ্গে ঘরে চলে আসি। তবে মনের মধ্যে একটাই প্রশ্ন বার বার স্লোগান তুলছে, নিপা ভাবী কোথায় গেল?
–
ঘটনার সূত্রপাত সেদিন থেকেই। মাঝ রাতে হঠাৎ পেটে প্রচন্দ ব্যাথা অনুভব হতেই ঘুমটা ভেঙে যায় আমার। ভেবেছিলাম তুষারকে জাগিয়ে তুলবো। কিন্তু এই সামান্য কারণের জন্য তাকে জাগিয়ে তোলার ইচ্ছে হলো না। সারাদিন কত খাটুনি করে লোকটা। ঘড়ির কাঁটায় তখন বোধহয় ২:৩৫। আমি বিছানা ছেড়ে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসি।রান্নাঘরে যাই। ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি বের করে পান করি। হঠাৎ মনে হলো ড্রয়িং রুমে কেউ একজন বসে আছে। একনাগাড়ে কিছু একটা বিরবির করছে। বিষ্ময়ে আমার ভ্রু কুঁচকে এলো। মাত্রই তো ড্রয়িং রুমের সামনে দিয়ে এলাম। তখন তো কাউকে দেখলাম না?
সাহস করে ড্রয়িং রুমের দিকে এগুতে লাগলাম। যত এগুচ্ছি ততই শব্দটা বেড়েই যাচ্ছে সঙ্গে সোফায় বসে থাকা ব্যাক্তির ছায়াটাও ড্রিম লাইটের আলোয় বড় হচ্ছে। কাছে যেতেই দেখি একটা কালো কুচকুচে বিড়াল। আমার দিকেই অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে ম্যাঁও ম্যাঁও করছে। বিরবির শব্দটা এখন আর নেই। বোধহয় মনের ভ্রম ছিল।
‘এ দেখি একটা বিড়াল! কিন্তু এটা ঘরে কি করে ডুকলো?’
হঠাৎ চোখ যায় জানালার দিকে। দেখতে পাই জানালা খোলা। তার মানে জানালাটা আজকে আর লাগানো হয় নি। কিন্তু স্পষ্ট মনে আছে বিকেলেই আমি রোজকার মত সব জানালা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। বিড়ালটিকে তাড়াতে হয় না। সে নিজেই জানালা দিয়ে বেড়িয়ে যায়। হঠাৎ আমার চোখ যায় জানালার বহির্ভূত দৃশ্যের দিকে। কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। অথচ কি দেখা যাচ্ছে তা আমি ঠিক করে আন্দাজ করতে পারছি না। অকস্মাৎ আমার পেছন থেকে একটা অদ্ভুত ভারী গলা ভেসে আসে,
‘ তোর বাচ্চাটা আমায় দিবি?’
আমার মাথাটা হঠাৎ ব্যাথায় ছটফট করে উঠে। পেছন ফিরে তাকানোর আগেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। পরে কি হয়েছিল মনে নেই। সকালে যখন ঘুম ভাঙে তখন দেখি তুষার আমার পাশেই বসে আছে। স্বামীকে রাতের কথা জিজ্ঞেস করতেই সে বলল,
‘আমি তো ওয়াশরুমের জন্য উঠেছিলাম। হঠাৎ দেখলাম তুমি পাশে নেই। তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে যখন নিচে নেমে আসি তখন দেখতে পাই তুমি ড্রয়িং রুমের মেঝেতে পড়ে আছো। তারপর আর কি?তোমাকে কোলে তুলে রুমে এনে শোয়ালাম। কি হয়েছিল বলো তো?’
কিছুই মনে পড়ছিল না। তাই উত্তর দিতে চেয়েও তুষারকে কিছু বলতে পারলাম না। তবে কানে এখনো একটা কথাই বাজছে,
‘তোর বাচ্চাটা আমায় দিবি?’
—---
আজ এই বাড়িতে আমার একমাস পূর্ণ হলো।এই এক মাসে আমার সঙ্গে তেমন কিছুই ঘটে নি। সব স্বাভাবিক ছিল। কাল সকালে তুষার খাগড়াছড়ি যাবে। তিন দিনের একটা মিশনে। এ ক'দিন সে অনেক জায়গায় একটা মেয়ে মানুষ খুঁজেছে ২৪ ঘন্টা আমার তদারকি করার জন্য। আমার সঙ্গে থাকার জন্য। কিন্তু এটা তো আর ঢাকা শহর না যে মানুষ চাইলাম আর মেয়ে পেয়ে গেলাম। তুষার আমাকে একা রেখে কিছুতেই যেতে চাইছিল না। কিন্তু কি আর করার? সরকারি চাকরি বলে কথা!
বিকেলে বাহিরে থেকে কাপড় আনতে গিয়ে দেখি কোথা থেকে যেন নিপা ভাবী ব্যাগ-পত্তর নিয়ে বাড়ি ডুকছে। সঙ্গে ছোট একটা মেয়ে,একজন পুরুষ আর দু'জন বৃদ্ধা-বৃদ্ধও ছিল। আমি ভাবী বলে হাঁক ছাড়তেই সে আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো।
‘ভাবী কোথা থেকে আসছেন?এত সব নিয়ে কোথায় গিয়েছিলেন?যাক এক মাস পর আপনার পরিবারের সদস্যদের দেখা মিলল।বাচ্চা গুলো তো বিকেলে বাহিরেও আসে না।’
নিপা ভাবীর কপালে ভাঁজ পড়লো এবার। সে আমার বাড়ির দিকে একবার তাকালো তারপর বলল,
‘আপনি আমাকে কি করে চিনেন?আমার নাম কি করে জানলেন?আর আপনাকে তো আমি ঠিক চিনতে পারলাম না?কে আপনি?’
নিপা ভাবীর কথায় আমি পুরোই কিংকর্তব্যবিমুঢ়। এসব কি বলছে উনি?এখানে আসার পর থেকেই উনার সাথে আমার কত ভাব। আর আজকে বলছে আমাকে নাকি সে চিনে না। আমি কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবো তার আগেই ভাবীর সঙ্গে থাকা পুরুষটি তাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল,
‘আতিয়া জলদি বাড়ির চাবিটা দাও। একমাসে না জানি ঘরের কি হাল হয়েছে। এই মণি তোর মায়ের থেকে চাবিটা নিয়ে আয় তো।’
ছোট্ট মেয়েটা দৌড়ে নিপা ভাবীর কাছে এলো চাবি নেওয়ার জন্য। নিপা ভাবী মেয়েটিকে বলল,
‘যাও আব্বুর কাছে। আম্মু আসছি।’
তারপর আমার দিকে একবার তাকিয়ে বলল,
‘পরে কথা হবে।’
ভাবী আমার জবাবের জন্য অপেক্ষা না করেই চলে গেল। সে চলে যেতেই লোকটি মৃদু কন্ঠে তাকে জিজ্ঞেস করল,কে ওই মহিলা?এই বাড়িতে উঠছে বুঝি?
সবাই আমার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকালো। আমার বেশ অস্তিত্ব লাগছিল। তাই এক মুহুর্ত দেরি না করে আমি কাপড় নিয়ে বাড়ির ভেতর চলে এলাম। তুষার বাড়িতেই ছিল। তাকে আমি সব খুলে বললাম। তার নিজের মাথাও কাজ করছে না। সে আর আমাকে কি বুঝাবে? এবার মাথায় আমার আরেকটা প্রশ্ন ভোঁ ভোঁ করছে, নিপা ভাবী আমাকে চিনতে পারলো না কেন?নাকি ইচ্ছে করেই কোন কারন বসত না চেনার ভান করেছে সে? আর ভাবীর তো কোন বাচ্চা নেই । তবে ভাবীর কথার ধরন শুনে কেন মনে হচ্ছিলো ছোট্ট মেয়েটি তার নিজেরই। আর ওই লোকটি তাকে আতিয়া বলেই বা কেন ডাকল?তার নাম তো নিপা।
—
সন্ধ্যায় হাসের মাংস আর চালের রুটি করেছি। শীতকালীন সময়ে এটা তুষারের পছন্দের খাবার। স্বামীটা আমার কাল চলে যাবে। না জানি এই তিনদিন কি না কি খায়। তাই যতটুকু পেরেছি,ততটুকুই করেছি। কাজ শেষে যখন এক বাটি মাংস আর রুটি নিয়ে চলে যাওয়ার জন্য রান্না ঘরের লাইটটা বন্ধ করে বেরিয়ে আসলাম তখনি নাকে একটা পঁচা দুর্গন্ধ এসে ধাক্কা খেল। বমি চলে আসার উপক্রম। হঠাৎ রান্নাঘর থেকে শব্দ এলো,মনে হলো কেউ পাতিলের ঢাকনা সরিয়েছে। আরেকটু খেয়াল করতেই এবার আরো অদ্ভুত এক শব্দ কানে বাজলো,মনে হলো কে যেন খপখপ করে সব ছিড়েখুঁড়ে খাচ্ছে। আমি দ্রুত টেবিলে মাংসের বাটিটা রেখে রান্না ঘরে ডুকলাম। লাইট অন করতেই দেখি সেখানে কিছুই নেই। সব স্বাভাবিক।নেই কোনো শব্দ, সেই কোলাহল। ধ্যাত আজ-কাল হরর মুভি একটু বেশিই দেখা হচ্ছে। তারই ইফেক্ট এসব।
সেদিন রাতে আমি সবচেয়ে বেশি অবাক হই। যখন রাতে খাবারের সময় রান্নাঘরে গিয়ে দেখি মাংসের পাতিলে এক টুকরো মাংসও নেই। পাতিলের তলায় শুধুমাত্র পড়ে আছে ঝোল। পর পর কেমন যেন সব অদ্ভুত ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। এখন নিজের ভেতরেও খানিকটা ভয় কাজ করা শুরু করে। সব সময় তো সবকিছু একজন মানুষের ভ্রম হওয়া সম্ভব নয়। তুষার কে বিষয়টি জানানোর পর যে বলে,
‘আজ তো রাত হয়ে গেছে। সকালে আমাকে আবার খাগড়াছড়িও যেতে হবে। তিনদিন একটু
কষ্ট করো। যদি দেখো তিনদিনে সব স্বাভাবিক আছে তাহলে তো ভালোই। তা না হলে আমি বাড়ি ফিরেই হুজুরকে এনে একটা মিলাদের ব্যবস্থা করবো।’
আমিও তাতে রাজি হলাম। তবুও তুষারের আমাকে ফেলে যেতে বেশ চিন্তা হচ্ছিলো। তাই সে আমার ছোট ননদকে কল করে দুই-একদিনের ভেতর এখানে আসতে বলে। সঙ্গে আমার শাশুড়ীও আসবে। শুনে একটু খুশী হলাম। বাড়িতে একা থাকার চেয়ে তাদের এখানে চলে আসাই ভালো। এমনিতেও বছর শেষেই আমার শশুর-শাশুরি আর ননদ-দেবরের এখানে চলে আসার কথা। কিন্তু সামনেই দেবরের এক্সাম আছে তাই সবাই ঠিক করেছে একেবারে বছরটা শেষ করেই তারা এখানে শিফট হবে।
-
পরদিন আমার দিনটা খুব একটা ভালো যায় না। তুষারের জন্য অনেক মন খারাপ হচ্ছিলো। অদ্ভুত একটা ভয়ও মনের মধ্যে বাসা বেঁধে বসে ছিলো।
সেদিন রাত দেড়টায় হঠাৎ বিকট এক শব্দে আচমকা ঘুম ভেঙে যায় আমার। রাত ভালোই হয়েছে। আমার আবার একটা বোধ অভ্যাস আছে। একবার ঘুম ভাঙলে সহজে ঘুম আসে না। তুষারটা চলে গেছে বিধায় মনটা কেমন কেমন জানি করছে। সারাটা দিনও আজকে কেমন যেন একগুয়ে কেটেছে। ফোনটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ ফেসবুকে স্ট্রোলিং করতে থাকি। হঠাৎ তুষারের কল আসে। প্রথমে একটু অবাক হই। এত রাতে কল করেছে?পরে ভাবলাম সারাদিন কাজ করে এখন হয়তো রাত জেগে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া হচ্ছে। ফোন রিসেভ করতেই তুষার একটা কথাই বলল,সব ঠিক আছে?
ব্যাস সঙ্গে সঙ্গে লাইনটা কেটে যায়। নেট সমস্যা হয়তো। আমি উঠে বারান্দায় যাই। হঠাৎ দোলনার দিকে তাকাতেই মনে হলো কে যেন দোলনায় পা ঝুলিয়ে বসে গুন গুন করছে। মেয়েলি কন্ঠস্বর। আমার শরীরটা শিউরে উঠে। আয়াতুল কুরসী পড়তে পড়তে বারান্দার দরজা বন্ধ করে রুমে চলে এলাম। তুষারকে বেশ কয়েকটি কল করি, কিন্তু ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে। খুব ভয় করছিল আমার। হঠাৎ আননোন নাম্বার থেকে একটা কল আসে,কলটা ধরতেই ওপার থেকে ভেসে আসে একটা অস্পষ্ট কন্ঠ। ভয়েজটা কেটে কেটে আসছিল। ভাবলাম হয়তো কোন সমস্যা হয়েছে দেখে তুষার অন্য কারো নাম্বার থেকে কল করেছে। নেট সমস্যার কারনে কথা অস্পষ্ট শোনাচ্ছে । একটা কল আসার পর আর কোন কল আসে নি।তাই আমিও আর এহেন বিষয়ে এত মাথা ঘামালাম না। ঘুম আসছে না।এখনো ভয় করছে। বিছানায় এসে দোয়া পড়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছি। হঠাৎ অনুভূত হলো পিঠের ওপর কেমন যেন শীতল নিঃশ্বাস পতন হচ্ছে। ধীরে ধীরে নিঃশ্বাসের শব্দ বাড়তে শুরু করে। মনে হচ্ছে এই তো ঠিক আমার পেছনেই কেও একজন শুয়ে আছে। কিন্তু সেটা তো অসম্ভব বিষয়। বাড়িতে তো এই মুহুর্তে আমি ব্যাতিত কেউ নেই?আমি আয়াতুল্লাহ কুরসী আরো দ্রুত পড়তে শুরু করলাম।যত গুলো দোয়া মাথায় আসছে অনবরত তা পাঠ করছি। কিন্তু নিঃশ্বাসের শীতল বাতাসটা তখনো আমার পিঠে লাগছে। এবার আমি দোয়া পড়তে পড়তে আস্তে আস্তে করে ঘাড় বাঁকিয়ে পেছনে ফেরার চেষ্টা করি। পেছন ফিরতেই আমার চক্ষু চড়কগাছ।মুখ থেকে অস্পষ্ট স্বরে শুধু বেরিয়ে আসে,
‘নিপা ভাবী?’........
✨সমাপ্ত

·160 Views
·0 Reviews