Upgrade to Pro

আপনার অনুমতি নেই

রিক্সাওয়ালা মামার হজ্ব

শেয়ার করার লোভ সামলাতে পারলাম না। এমনই হওয়া উচিত আমাদের।

.........

গত বছর এই সময়ে এক আত্মীয়ের সাথে গিয়েছিলাম হজ্জ ক্যাম্পে। রিক্সা থেকে নেমে ভাড়ার টাকা এগিয়ে দিতেই রিক্সাওয়ালা মামা বললেন লাগবো না।

ভাবলাম ভাড়া কী কম হয়ে গেলো নাকি!  তাড়া ছিলো তাই ভাড়া ঠিক না করেই উঠে পড়েছিলাম।  যদিও এখানকার ভাড়া মোটামুটি ফিক্সড,  তবে একটা ভালো কাজে এসেছি - মূলামুলি না করে,  পকেট হাতড়ে আরো কিছু টাকা মিলিয়ে  বাড়িয়ে দিলাম  মামার দিকে।

কিন্তু মামা এবারেও সলজ্জ বদনে টাকাটা ফিরিয়ে দিলেন।

বললাম কী সমস্যা মামা, এই ভাড়ায় পোষাচ্ছে না?

 

রিক্সাওয়ালা মামা লজ্জায়  জিভ কেটে বললেন

- ছি ছি মামা, আপনে তো  ম্যালা টাকা দিসেন। কিন্তু আমি ভাড়াটা নিতাম  না ।

 

- কেনো নিবেন না?

 

- আসলে মামা,  কোনো হজ্জ  যাত্রীর ভাড়া আমি নেই না। 

 

আমি খুব অবাক হয়ে  হয়ে বলি

- সে কী কথা!  রিক্সা চালানো তো  আপনার পেশা। ভাড়া না নিলে আপনার চলবে  কীভাবে?  আপনার বাড়ি কোই?

 

- গাইবান্ধা। 

 

- উত্তর বঙ্গের লোক বোকাসোকা ভালো মানুষ হয় জানতাম,  কিন্তু  এই ভালোমানুষি ধোয়া পানি খেলে  তো আর পেট ভরবে না। সংসার চলে কীভাবে?

 

- আসলে মামা, আমি দিনমজুর। দিন আনি দিন খাই। ঢাকায় আসছি এই কয়দিন হইলো।  দ্যাশের বাড়িতে ভ্যান চালাইয়া সংসার চালাই। টানাটানির সংসারে টাকা জমানো খুবই কঠিন।  তবু চেষ্টা থাকে কিছু জমানের। বাকিটা আল্লাহয় সহজ কইরা দ্যান।

প্রতি বছর হজ্জের মৌসুমে আমি যখন ঢাকায় আসি তখন পরিবারের হাতে জমানো টাকাডি দিয়া আসি। তাই বিশেষ সমস্যা হয় না। 

 

- আর ঢাকায়  আপনার থাকা খাওয়া? 

 

-  হজ্জ যাত্রী ছাড়া বাকি সবার থিকা তো ভাড়া নেই।  তাইতে আল্লাহয় একটা  ব্যবস্থা কইরা দ্যান। ট্যাকায় বরকত আইসা পড়ে।

 

- সে নাহয়  বুঝলাম। কিন্তু আপনার এরকম বিনা পয়সায় যাত্রী সার্ভিস দেয়ার  ইচ্ছা কেনো হলো, কারনটা কি জানতে পারি?

 

- কী বলবো মামা, শুনলে লোকে হাসে। টিটকারি মারে।

 

- আপনি  নির্দিধায় বলেন মামা,  আমি শুনবো।

 

- আসলে মামা হইসে কী... আমার ম্যালা বছরের শখ... বলতে পারেন অন্তরের খায়েস - জীবনে একবার হইলেও আমি  মোহাম্মদের (সঃ) দ্যাশে যাবো...  যেইখানে আল্লাহর ঘর আছে, সেই ঘর তওয়াফ করবো । জান্নাতি  কালা পাথরে চুমা খাবো। সাফা মারওয়া সাই করবো..... আহা কতো নবী রাসূলের পাও মোবারক পড়সে সেই জমিনে....

আবেগে  মামার চোখে জল জমা হয়। কাঁধে ঝোলানো  গামছাটা  দিয়ে চোখ জোড়া কচলে মুছে নেন তিনি।

 

- মাশাআল্লাহ খুবই ভালো শখ কিন্তু ওখানে যেতে হলে তো  অনেক টাকা লাগে  মামা। এইভাবে ফ্রী সার্ভিস দিলে টাকা জমাবেন কিভাবে। কতো টাকা জমিয়েছেন এই পর্যন্ত?

 

- এট্টা টাকাও না।

 

- এক টাকাও না জমিয়ে আপনি কিভাবে ঐ দেশে যাওয়ার ইচ্ছা পূরণ করবেন মামা?  ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখার মতো হলো না বিষয়টা!

 

- কীভাবে যাবো ঐটা আমি  জানিনা, জানেন ঐ একজন।

হাতের তর্জনী উঁচিয়ে আসমানের দিকে ইশারা করেন মামা।

তয় একদিন না একদিন  যাবো ইনশাআল্লাহ ।  মালিকের উপ্রে আমার পুরা ভরসা আছে।

 

পয়সার জোগাড় নাই অথচ স্বপ্ন দেখে হজ্জে যাবার! ওখানে যেতে হলে যে পরিমান টাকার প্রয়োজন, সে হয়তো সারাজীবনে চোখেও দেখবে  না, খরচ করা তো দূর কী বাত!

মামার মূর্খতা দেখে  হাসি পেলো তবে  চেপে গেলাম। বললাম

- চেষ্টা না করে শুধু  আল্লাহর ভরসায়  চুপচাপ বসে থাকলে  যদি কাজ হতো,   তাহলে কতই না ভালো হতো।  জানেন মামা, আমারো কাজকাম করতে ভালো লাগে না।  আল্লাহর উপর ভরসা করে  লেপ গায়ে দিয়ে শুয়ে  থাকলাম আর আসমান থেকে টুপ করে খাবার পড়লো। কী মজা হতো  তাই না!

 

-  আপনেও  মজা লইলেন মামা! চেষ্টা করি না কে বললো? করি তো!

 

- আপনি যে ব্যাগার খাটছেন, যাত্রীর থেকে ভাড়া নিচ্ছেন না। তাহলে টাকা জমাবেন কীভাবে আর সেই দেশেই বা যাবেন কীভাবে? 

 

এবার মামা শব্দ করে হেসে উঠলেন। বললেন

- মামা আপনারা শিক্ষিত জ্ঞানী মানুষ, অনেক বেশি  জানেন। তয় আমি ছোট মুখে একখান বড়ো কথা বলি।

শুনছি হাদিসে আছে, কোনো মানুষ তার আমলের দ্বারা জান্নাতে যাইবো না। জান্নাতে যাইতে পারবো একমাত্র আল্লাহর দয়ায়। মানে হইলো গিয়া - একজন মানুষ অনেক আমল করলো, আমলের পাহাড় নিয়া দাড়াইলো হাশরের ময়দানে কিন্তু আল্লাহ যদি দয়া না করেন, তার আমল পছন্দ না করেন তাইলে কিন্তু ঐ নেকির পাহাড়  কোনোই কাজে লাগতো  না।

সেই জন্য আমি আমার মালিকরে খুশি করার চেষ্টা করতেসি। মালিকরে যদি একবার সন্তুষ্ট করতে পারি তাইলে আমারে আর ঠেকায় কে! সে আমারে  কীভাবে  কার মাধ্যমে নিবো তিনিই  ভালো জানেন। আমার কাজ খালি মালিকরে খুশি করা আর সেই উদ্দেশ্যেই আমি হজ্জ যাত্রী পাইলে তাদের থিকা টাকা নেই না, তাদের বোঝা টাইনা দেই।  যতদূর সম্ভব খেদমত করার চেষ্টা করি। মানুষ নানান তরিকায় মালিকরে খুশি করার চেষ্টা করে,  আমার তরিকা এইটা।  তেনাদের দোয়ার উছিলায় যদি  মালিক আমার নিয়ত কবুল করেন- এই আশা মনে।

- খুব ভালো কথা বলেছেন মামা। তবে একটা কথা আছে না- দোয়ার সাথে দাওয়াও লাগে। আপনি টাকার ব্যবস্থা না করে খালি হাতে কীভাবে ইচ্ছা পূরণ করবেন সে ব্যপারে কিছু ভেবেছেন?

 

আবারো শব্দ করে হেসে উঠলেন মামা। বললেন

- মামায় যে কী কয়! ট্যাকার কোনো ক্ষেমতা আছে নি ! কত্তো মানুষ ট্যাকার গাট্টি নিয়া বইসা আছে।  সবাই কী ঐখানে যাইবার পারে? নসিবে থাকতে হয় বোজলেন। যেইখানে আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া একটা গাছের পাতাও নড়ে না, সেইখানে ট্যাকার কী দাম  বলেন তো মামা!

 

রিকসাওয়ালা মামার হাইথট কথাবার্তা আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছিলো।  আর কথা বাড়ালাম না। বললাম

- চলি মামা, অনেক কথা হলো ভালো লাগলো। আপনার সাথে একটা সেলফি নিই,  কী বলেন।

 

-  ফেসবুকে দিবেননি মামা?

বিগলিত হাসি দিয়ে  মামা হাতের আঙুলের সাহায্যে  চুলগুলো  ঠিকঠাক করে  নিলেন।

 

- আরেহ না না, আমার ওসব বাতিক নাই । আপনার কথাগুলো মনে ধরেছে । স্মৃতি হিসেবে একটা ছবি থাকুক, এই আরকি।  আর আমার মোবাইল নম্বরটা রাখেন।যদি কোনোদিন আপনার ইচ্ছা পূরণ হয়,  আমাকে কাইন্ডলি একটু   জানাবেন। সামর্থ্য মতো সহযোগিতা করবো ইনশাআল্লাহ। 

ঐদিন মামার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম  তবে তার কথাগুলো অনেকদিন পর্যন্ত মাথায় ঘুরতো। একজন আধা শিক্ষিত মানুষ,  অথবা কে জানে তিনি হয়তো কোনোদিন স্কুলের বারান্দায় পা-ও রাখেননি, এমন একজন মানুষ আমার ভাবনার জগতকে বেশ প্রভাবিত করলো।  সময়ের পরিক্রমায়  তারপর একদিন সব ভুলেও গেলাম।

-

-

 

কয়েকদিন আগে একটা আননোন নম্বর থেকে  কল এলো। অচেনা নাম্বার আমি সাধারণত রিসিভ করি না, তবে কী মনে করে ধরলাম। হ্যালো বলতেই ও পাশ থেকে সেই মামার কন্ঠ  শোনা গেলো

- মামা আমারে চিনতে পারছেন?  ঐ যে গত বছর হজ্জ ক্যাম্পের সামনে অনেক কথা হইলো। আমি আরিফুল।

 

- জ্বি  জ্বি,  কেমন আছেন? 

 

- জ্বে  আপনেদের দোয়ার বরকতে ভালোই আছি।  মামা, কাইল ইকটু দেখা করতে চাই। আসতে পারবেননি? 

 

যদিও ফোনে কিছু বলেননি তবে ধারণা করলাম হয়তো টাকার বিশেষ  প্রয়োজন হয়েছে।   কাছে সামান্য যতটুকু  টাকা ছিলো, গুছিয়ে  নির্ধারিত জায়গায় চলে গেলাম।

 

এক বছরের ব্যবধানে  মামাকে দেখে প্রথমে চিনতেই পারিনি। না, ওনার চেহারা শরীর স্বাস্থ্য আগের মতোই আছে তবে বদলেছে তার বেশ। শুভ্র- সাদা ইহরামের চাদরে জড়ানো মামাকে দেখে বুকের ভেতর ধক্ করে উঠলো। তবে কী তার নিয়ত কবুল   হয়ে গেলো?  কিন্তু কীভাবে সম্ভব? 

কাছে যেতেই দৌড়ে এসে হাত মুসাফা করে বললেন

-   জানেন আমার মালিক আমারে ডাইকা পাঠাইসেন। আইজ রাততিরে আমার ফেলাইট। আমি মোহাম্মদের (সঃ) দ্যাশে যাইতাসি মামা!

 

আমি শক্ত মনের মানুষ, তবু  মামার আনন্দোচ্ছ্বাস  দেখে আমার চোখে জল জমা হলো।   বললাম - মাশাআল্লাহ দারুণ খবর!  কিন্তু কীভাবে সম্ভব হলো মামা, একটু বুঝিয়ে বলবেন? 

 

- আর বইলেন না মামা, একদিন রিসকা টানতে টানতে গপসপ করতেসিলাম। হঠাৎ সেই যাত্রী বললেন  তিনি তার পুরা পরিবার নিয়া হজ্জে যাইতেছেন কিন্তু একটা সমস্যায় পড়ছেন। তার  বৃদ্ধা অসুস্থ  মা একলা চলাচল করতে পারেন না। তার আম্মারে ধইরা ওঠানামা করার জন্য একজন শক্ত সামর্থ্য মানুষ দরকার। আমি যদি রাজি থাকি তাইলে পুরা খরচ দিয়া আমারে তিনি সাথে নিয়া যাবেন।

কাকার  কথা শুইনা আমি তক্ষনি চিৎকার দিয়া কাইন্দা উঠি আর বলতে থাকি "" আল্লাহ তুমি আছো.... আল্লাহ তুমি আছো "।

কাকায়  নিজেই আমার পাসপুট ভিসা করাইলেন, কাপুরচুপুর যা লাগে সবতা কিন্না দিলেন। বলছিলাম না মামা, আল্লাহয় চাইলে কী না হয়!

 

মামার কথা শুনে আমার সারা শরীর শিউরে উঠলো, সুবহানআল্লাহ! এ-ও সম্ভব!  নিয়ে আসা টাকার প্যাকেট মামার হাতে দিয়ে বললাম এটা রাখেন, যদি কোনো কাজে লাগে।

 

মামা এবারো ফিরিয়ে দিয়ে বললেন

লাগবো না মামা। আপনে খালি আমার জন্য দোয়া কইরেন। মালিক জানি আমার হজ্জ ওমরা কবুল করেন। 

 

আমি পুনরায় টাকাটা এগিয়ে দিয়ে বলি

- অবশ্যই দোয়া করি মামা, তবে এই টাকাটা আপনাকে নিতেই হবে। নিয়ত করে নিয়ে আসছি, ফেরত নিবো না।  যে কোনো ভালো কাজে খরচ করিয়েন। নিজে তো যেতে পারলাম না, অন্তত একটা সওয়াবের কাজে শরিক হলাম।

 

-  কঠিন  নিয়ত রাখেন মামা, একদিন আপনেও যাইতে পারবেন ইনশাআল্লাহ।

 

- ইনশাআল্লাহ! 

 

দূর থেকে দেখছি  "লাব্বাঈক আল্লাহুম্মা লাব্বাঈক " ধ্বনিতে সুর তুলে সম্মানিত হাজীগণের সাথে এক কাতারে এগিয়ে চলেছেন একজন অর্থ -বিত্তহীন ভ্যানচালক আরিফুল মামা। তিনি শিক্ষিত নন , নেই  এ্যাকাডেমিক সার্টিফিকেট। সহায় - সম্পত্তি খ্যাতি কিছুই নেই তার, সমাজে কেউ তাকে চেনে না। তবে যিনি চেনার তিনি ঠিকই চিনেছেন এবং পুরষ্কারও এই দুনিয়ায় দিয়ে দিলেন।  ভাবছি মামার ইয়াকীনের কতো জোর! অথচ আমি কেমন  ইলম অর্জন করলাম যে রবের প্রতি পূর্ণ তাওয়াক্কুল রাখতে পারি না।

কোথায় যেন শুনেছিলাম - "আল্লাহ বান্দার সাথে তার ধারণা অনুযায়ী আচরণ করেন।" দুআ করার সময় বান্দা যদি পূর্ণ আস্থা রাখে যে তাকে ফিরিয়ে দেয়া হবে না, তাহলে রব  তাকে সত্যিই ফিরিয়ে দেন না। যার ইয়াকীনের জোর যত বেশি, তার দুআ কবুলের  সম্ভাবনা ততো বেশি।

নিজেকে প্রবোধ দিলাম-  সময় এখনো ফুরিয়ে  যায়নি,  সংশোধন হতে  হবে।

 

অবশেষে  প্রশান্ত চিত্তে মামাকে বিদায় জানিয়ে বাড়ির পথ ধরলাম। আল্লাহ আমার এবং মামার সমস্ত  নেক ইচ্ছা  কবুল করুন। 

(সমাপ্ত) 

 

– সাদেকুর রহমান

Love
Like
Haha
25
Jono Sathi - Bangladeshi Social Media Platform https://jonosathi.com